ছোটঘরের ভালোবাসা পর্বঃ ০৭(শেষ পর্ব)

0
1030

ছোটঘরের ভালোবাসা পর্বঃ ০৭(শেষ পর্ব)

– আবির খান

একদিন হঠাৎ আবির ভারসিটিতে ঢুকতেই সানজিদা আবিরকে টেনে ভারসিটির মাঝে এনে সবার সামনে ওপেন প্রপোজ করে বসে। আবিরতো পুরা ভেবাচেকা খেয়ে যায়। আবির চারদিকে তাকায়। দেখে ক্যাম্পাসের প্রায় সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আবিরের চোখ যায় রিয়ার দিকে। রিয়ার চোখগুলো অশ্রুতে ভরা।

আসলে এই কয়দিনে রিয়াও আবিরের প্রেমে পরে যায় কিন্তু মুখে বলতে পারে না। কারন সে আবিরের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে। তাই রিয়া আজ আবিরকে অন্য কারো হতে দেখে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। রিয়া আর একমুহূর্ত সেখানে দাড়াতে পারে না। দৌড়ে চলে যায়। আবির তা স্পষ্ট দেখলো।

সানজিদাঃ আবির তুমি একদিন বলে ছিলে না, যে তোমার কাছে কি চাই। আজ চাচ্ছি শুধু তোমাকে। আবির আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। অনেক মানে অনেক।

আবির সানজিদাকে কি বলবে। কিভাবে ওকে বুঝাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। আবির জানে সানজিদা খুবই সেন্সিটিভ। তাই তাকে এ বিষয়টা খুবই সাবধানে দেখতে হবে।

আবির সানজিদার হাত ধরে নিচে বসা থেকে দাড় করায়।

আবিরঃ সানজিদা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। প্লিজ আগে সেগুলো শুনো।

সানজিদাঃ কি কথা বলো।

আবিরঃ এখানে নাহ।আসো আমার সাথে।

আবির সানজিদাকে নিয়ে একটা নিরব জায়গায় গেলো। মানে সবার আড়ালে।

আবিরঃ দেখো সানজিদা, আমি এখানে এসব প্রেম ভালোবাসা করতে আসি নি। আমার মা বাবার কিছু স্বপ্ন আছে তা পূরণ করতে এসেছি। আমি চাইলেই এসবে জড়াতে পারবো না সানজিদা। তুমি খুবই সুন্দরী আর রূপবতী ভালো একটা মেয়ে। তোমার মন স্বচ্ছ পানির মতো। তুমি চাইলেই আমার চেয়ে ১০০ গুণ ভালো ছেলেকে পাবে। প্লিজ আমাকে বুঝার চেষ্টা করো। আমাকে মাফ করে দিও। আমি পারবো না কাউকে ভালোবাসতে। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি অনেক ছোট ঘরেরর ছেলে। সেই ছোট ঘরে কোনদিন তুমি আমায় ভালোবাসতে পারবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে বিন্দু মাত্র কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু আমি অপারগ।

সানজিদা আবিরের কথা গুলো শুনে আস্তে করে উঠে চলে যায়। এরপর আর কোনদিন সানজিদা আবিরের সাথে কথা বলে নি। ক্লাস এ সবার সাথে কথা বললেও আবিরের সাথে বলতো না। আবিরও এখন আর কারো সাথে মিলে না। ভারসিটিতে ক্লাস করে সোজা বাসায় চলে যায়। রিয়া বেশ কদিন ভারসিটিতে আসে নি সেদিনের পর। এরপর এসে ছিলো তবে আবিরের সাথে কথা বলতে পারে নি। কারণ আবির সবাইকেই এড়িয়ে চলতো। আবির সম্পুর্ন নিজেকে একা করে ফেলে। এখন শুধু মনোযোগ সহকারে পড়া লেখা করছে।

আবিরের এ আচরণে রিয়া অনেক কষ্ট পায়। রিয়া অনেক চেষ্টা করেছে আবিরের সাথে কথা বলার বন্ধুত্ব করার কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আবির সম্পুর্ন নিজেকে একা করে ফেলেছে। কারণ ছাড়া একটা কথা বলে না কারো সাথে।

একদিন,
রিয়াঃ আবির দাড়াও। দাড়াও বলছি।(আবিরের সামনে গিয়ে)

আবিরঃ….

রিয়াঃ কি সমস্যা কি??হয়েছে টা কি??এভাবে এড়িয়ে চলো কেনো আমাকে??

আবিরঃ…

রিয়াঃ আমি কি এতোই খারাপ করেছি তোমার সাথে যে তোমার বন্ধু হওয়ার সুযোগটুকু নেই??

আবিরঃ আমি কারো প্রতি রাগ না। আর আমি কাউকে বন্ধু বানাতে চাইনা। আমি একাই ভালো আছি।

বলেই রিয়াকে সড়িয়ে আবির চলে যায়। রিয়া দাড়িয়ে দাড়িয়ে আবিরের চলে যাওয়া দেখছে আর ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

এভাবে প্রায় আরো ১ টি বছর কেটে যায়। আবির এখন ৩য় বর্ষে।

আবির এখন অনেকগুলো টিউশনি করায়। কারণ তাকে প্রতি মাসে এখন ২০ হাজার টাকা তার মায়ের কাছে গ্রামে পাঠাতে হয়। কারণ তার মা এক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আবির হিমসিম খেয়ে যায় এতো গুলো টিউশনি করাতে গিয়ে। এরমধ্যে আবার নিজের পড়াশোনা। সব মিলিয়ে আগের আবিরকে এখন চিনার উপায় নেই। এরমধ্যে প্রতিদিন চাচি বকাবকি করে আবিরকে রাত করে বাসায় ফিরে বলে।চাচা কোন ভাবে আবিরকে আগলে রাখে চাচির থেকে। মাঝে মাঝে আবিরের কাছ থেকে অনেক টাকাও নিয়ে যায়। ফলে আবিরের হাত খরচের টাকাও থাকেনা। হেটে হেটে আসতে হয় বাসায়।

এমনই একদিনে আবির অনেক রাত করে টিউশনি পড়িয়ে একটা সুনসান রাস্তা দিয়ে হেটে হেটে বাসায় যাচ্ছিলো। রাস্তার দুপাশে বড় বড় বিল্ডিং। কেমম চুপচাপ চারদিকটা৷ এভাবে হাটতে ভালো লাগছে। হঠাৎ আবিরের কানে মৃদু মৃদু গোংরানির শব্দ আসছে। আবির শব্দের উৎস ধরে এগোতে এগোতে দেখে একটা চিপা গলিতে কিছু ছেলে মিলে একটা মেয়ের সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবির ছেলে গুলোর জন্য মেয়েটি দেখতে পাচ্ছে না।

আবির তারাতারি এগিয়ে গিয়ে যাকে দেখে তাকে দেখার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। আবির দেখে সে মেয়েটি আর কেউ নয় রিয়া। রিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। তবে ওর সাথে এখানো খারাপ কিছু করতে পারেনি। জোরাজোরি করতে ছিলো শয়তান গুলা। রিয়া আবিরকে দেখে আরো বেশি কেদে দেয়। আবিরের চোখগুলোও অজানা কষ্টে অশ্রুসিক্ত হয়ে পরে।

ছেলেগুলোর একজনঃ কিরে তুইও খেলবি নাকি আমাদের সাথে??আয় মজা হবে। হেব্বি মা* বস।হা হা।(বাকি রাও হাসছে)

আবিরের শরীর রাগে কষ্টে জ্বলে যাচ্ছে। আবির পাশে তাকিয়ে দেখে একটা ভাংগা রডের দন্ড। আবির তা হাতে তুলে নিয়ে এমন মাইর শুরু করে যে রিয়া পর্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। আজ আবির শয়তান গুলোকে মেরেই ফেলবে। আবিরের আজ নিজেকে পুরুষ বলে ঘৃনা হচ্ছে। কিভাবে পারে এরা একটা মায়ের জাতের সাথে এমনটা করতে। আবিরের রাগ আরো বেরে যাচ্ছে এসব চিন্তা করে। আজ মেরেই ফেলবে সবগুলোকে। রিয়া আবিরের অবস্থা দেখে কোন ভাবে ওকে থামায়। সবগুলো মার খেয়ে সেখানেই মরার মতো পরে আছে।

আবির রডটা হাত থেকে ফেলে রিয়ার দিকে তাকায়। রিয়ার লজ্জা লাগছে সাথে আবিরেরও। আবির তার শার্টটা খুলে রিয়ার গায়ে জড়িয়ে দেয়।

রিয়ার এখন খুব নিজেকে সেইফ মনে হচ্ছে। কিন্তু তার সাথে একটু আগে যা হতে নিচ্ছিলো তা ভেবে রিয়া ভয়ে কাদতে শুরু করে। শরীরে কোন শক্তি পাচ্ছেনা। আবির রিয়াকে তার বুকে জরিয়ে ধরে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্তনা দিচ্ছে।

আবিরঃ রিয়া আর ভয় পেয়েও না। তোমার আর কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না। শান্ত হও।

কিন্তু রিয়া অবিরাম কেদেই চলছে। আবিরের শার্টের নিচে থাকা গেঞ্জিটা ভিজিয়ে ফেলেছে রিয়া কেদে কেদে।

আসলে একটা মেয়ে যখন তার সব কিছু হারাতে যাচ্ছিলো তাও কিছু নরপশুর কাছে, তখন তার অবস্থা কি রকম হতে পারে তা আমি লিখে আপনাদের কখনো বুঝাতে পারবো না। একটা মেয়ের কাছে তার সতিত্বটাই তার সব। আর সেটা যখন এ সব নরপশুর কাছে নষ্ট হতে নেয় তখন তার কাছে মৃত্যুটাই শ্রেয়তর। কারণ এ যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা অনেক গুণ ভালো।

যে মায়ের জাত আমাদের জন্ম দিয়েছেন সেই মায়ের জাতের সাথে কিভাবে আমরা পুরুষেরা এরকমটা করি?? ১০০ পুরুষের মধ্যে মাত্র ২ জন পুরুষ পাবেন যারা ভাবে যে মেয়েরা তাদের মায়ের জাত। কিন্তু বাকিরা ভাবে মেয়েরা হলো শুধু তাদের চাহিদা পূরনের পাত্র মাত্র। না রে ভাই না। এরকম টা আর ভাবিস না। তারা না থাকলে এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখার কোনোদিন আমাদের সুযোগ হতো না।তারা আছে বলেই আমরা আছি। একটা বাবা তার সন্তানকে বাইরে ফেলে দিতে পারলেও একটা মা কোনদিন নিজে শেষ হয়ে যাবে তাও সন্তানের বিন্দু মাত্র ক্ষতি হতে দিবে না। সেই মায়ের জাতের সাথে কিভাবে আমরা পুরুষেরা এরকম পশুর মতো আচরণ করি??কিভাবে?? আজ নিজেকে পুরুষ ভাবতেও খারাপ লাগে। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ, যে আর খবরের কাগজের প্রথম পেইজে কোন মা, বোন বা মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া খারাপ কোন সংবাদ দেখতে চাইনা। দেখতে চাই এরকম খবর, এক মেয়েকে ধর্ষন থেকে বাচিয়েছে এক যুবক। আমরা আশাবাদি। একটা ছোট্ট পরিবর্তন চাই শুধু।

আবির রিয়াকে অনেক কষ্টে অভয় দিয়ে শান্ত করে।

আবিরঃ রিয়া তুমি এখানে কিভাবে এলে??

রিয়াঃ আমি এই গলির থেকে ২ গলি আগে আমার একটা ফ্রেন্ডের জন্মদিন এটেন্ড করতে এসেছিলাম। আমি যখন সবাইকে বিদায় দিয়ে বাসার নিচে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, ঠিক তখনই কিছু ছেলে এসে আমাকে পিছন থেকে মুখ চেপে ধরে এখনে টেনে হিচরে নিয়ে আসে। আর এরপর…

রিয়া আর বলতে পারে না কান্নায় ভেঙে পরে।

আবিরঃ শান্ত হও রিয়া। তুমি মেয়েতো কি হয়েছে। তোমাকে সবাই দূর্বল ভাবলেও তুমি দূর্বল নও। তুমি নিজেকে বাচিয়ে রেখেছো। আমিতো শুধু তোমাকে সাহায্য করেছি।

রিয়াঃ তোমার মতো যদি সব ছেলেরা মেয়েদের ছায়া হয়ে এভাবে পাশে থাকতো তাহলে মেয়েরা কতই না সেইফ থাকতো। তোমাকে সত্যিই অনেক ধন্যবাদ। আজ তুমি আমার সব কিছু বাচিয়েছো। তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই।

আবিরঃ এটা আমার কর্তব্য রিয়া। ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। তবে আর কখনো এভাবে একা কোথাও যাবে না৷ অবশ্যই সাথে কাউকে রাখবে।

রিয়াঃ ওকে।

আবিরঃ এখন বলো কিভাবে বাসায় যাবে??

রিয়াঃ তোমার ফোনটা একটু দিবে?? আমার পার্সটা কোথায় যেন ফেলে এসেছি।

আবির ওর ফোনটা বের করে রিয়ার হাতে দেয়। রিয়া ফোন দিয়ে ওর ড্রাইভারকে খবর দিলে ড্রাইভার তারাতারি চলে আসে।

আবিরঃ তাহলে তুমি যাও। সাবধানে যেও। আর আজ যা হয়েছে তা খারাপ স্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও।

রিয়াঃ হুম।

তারপর রিয়া চলে যায়। আবিরও বাসায় চলে যায়। আজ খুব ক্লান্ত লাগছে আবিরের। তাই ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখে মায়া খাবার হাতে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা আসলেই অনেক ভালোবাসে আবিরকে।

আসলে আবিরের আজ অনেক ক্ষুধা পেয়েছিলো। আবির ভেবেছিলো আজ হয়তো আর খাবার পাবে না। কিন্তু মায়া ঠিকই খাবার নিয়ে এসেছে। আবিরের বড্ড খুশি লাগছে। এ খাবারটুকুর খুব প্রয়োজন ছিলো এখন।

আবির আস্তে করে মায়ার কাছে এগিয়ে যায়। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আর বলে,

আবিরঃ মায়া তুমি সত্যিই অনেক ভালো মেয়ে। আর একটা ভালো বোনও।

মায়াঃ আমি তোমার বোন পরে আগে বন্ধু।

আজ মায়ার অনেক দিন পর ভালো লাগছে। কারণ অনেক দিন পর আজ আবির ওর সাথে কথা বলছে। আবির এখন আর মায়ার সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কারণ সেটাতো আপনারা জানেনই।

মায়াঃ বসো তুমি। আমি খাইয়ে দেই??

আবিরঃ আচ্ছা দেও।

এরপর মায়া খুব যত্ন করে আবিরকে খাইয়ে দেয়। মায়ার ভালোবাসাটা খুব সুন্দর। মুখে কখনো বলবে না ভালোবাসি কিন্তু কাজে ঠিকই বুঝিয়ে দিবে সে কত ভালোবাসে আবিরকে। এটা মায়ার এই ছোটঘরের ভালোবাসা। খাওয়া শেষ হলে মায়া চলে যায়।

আবির ঘুমানোর জন্য শুয়ে পরে। কিন্তু আজ ঘুম আসছে না। কারণ আজ আবির একটি বারও তার মায়ের সাথে কথা বলতে পারে নি। এই যান্ত্রিক শহরে এতো ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো যে মাকে একটিবার ফোন দেওয়ারও সময় পায়নি।

রাত এখন ১২. ০৭ মিনিট। এখন যে মাকে ফোন দিবে তাও সম্ভব না। মা যে এখন ঘুমাচ্ছে। তাই আবির ফোনও দিতে পারছে না। আবির ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আজ এতো ক্লান্তির পরও ঘুম আসছে না। মনটা কেমন কেমন জানি করছে। অস্থির অস্থির লাগছে আবিরের।

হঠাৎই আবিরের ফোনটা বেজে উঠলো। আবির কিছুটা কেপে উঠলো। আবির ফোনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। মা ফোন দিয়েছে। কিন্তু এতো রাতে!!!আবির তারাতারি ফোনটা রিসিভ করে।

আবিরঃ হ্যালো মা তুমি ঘুমাও নি??

মাঃ নারে বাবা। তুই কি ঘুমিয়ে গেসিলি??(অসুস্থ কণ্ঠে)

আবিরঃ না মা। তোমার কথাই ভাবছিলাম।

মাঃ বাবা আবির অনেক দিন হয়েছে তোকে দেখিনা। তুই কাল আসবি বাবা। তোকে বড্ড খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

আবির মায়ের এরকম আকুতি শুনে বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

আবিরঃ মা এমন ভাবে বলছো কেন??আমি আসবো কালই আসবো। তুমি চিন্তা করো না। তোমাকেও খুব দেখতে ইচ্ছা করছে আমার মা।

মাঃ আয় বাবা আয়। শুন বাবা একটা কথা মনে রাখিস জীবনে অনেক কষ্ট আসবে কিন্তু হার মানবি না লড়াই করবি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। যেমনটা তোর বাবা করেছিলো।

আবিরঃ মা এখন এসব বলছো কেন??কাল আসলে বলো। তোমার শরীরটাতো অনেক খারাপ। তুমি এখন ঘুমাও আমি কাল সকালে চলে আসবো।

মাঃ আচ্ছা বাবা। তুই চিন্তা করিস না। আমি আজ পরম শান্তিতেই ঘুমাবো। কাল যে আমার ছেলে আসবে।

বলেই ফোন রেখে দেয় আবিরের মা। মায়ের কথাগুলো শুনে আবিরের কেমন জানি লাগছে।৷ হয়তো অসুস্থ তাই এসব কথা বলছে। আবির রাতে আর ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি। সকালে ঠিক যখন চোখটা একটু লেগে আসেছে কিছুক্ষনের জন্য ঠিক তখনই আবিরের ফোনটা আবার বেজে উঠে।

আবির দেখে সকাল ৬ টা বাজে। মা ফোন দিয়েছে।

আবিরঃ হ্যালো মা।

মহিলাঃ বাবা আমি রোজিনা খালা। তুমি এখনই তোমার মায়ের কাছে চলে আসো। তার শরীরটা বেশি ভালো না।

আবির এ কথা শুনে আঁতকে উঠে।

আবিরঃ আসছি খালা। খালা মা কই তারে দেন আমি একটু কথা বলি।

রোজিনা খালাঃ সে তো ঘুমায় রে বাবা৷ তুমি আর সময় নষ্ট না কইরা চইলা আসো।(কথা কেমন ভাবে যেন বলল)

বলেই ফোনটা রেখে দিলো। আবির তারাতাড়ি উঠে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরে গ্রামের উদ্দেশ্য। চাচা চাচি মায়া কেউ জানেনা আবির কোথায় গিয়েছে। আবির ট্রেনে উঠে ফিরে যাচ্ছে তার অসুস্থ মায়ের কাছে।

সকাল ৯ টা,
রিয়া আজ খুব সকালে এসেই আবিরের জন্য অপেক্ষা করছে। গতরাতে আবির ওর জন্য যা করেছে তার ঋণ রিয়া কোনদিনও পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু রিয়া চায় আবিরকে তার ভালোবাসা দিয়ে তার পাশে সারাজীবন থাকতে। কারণ প্রতি মেয়েই আবিরের মতো একজন পূরুষকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে চায়। রিয়াও চায় আবিরকে। যে আবির তার সতিত্ব রক্ষা করার জন্য নিজেকে বাজি রাখতে পারে সে অন্তত কোনদিন তাকে কষ্ট দিবে না। রিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বসে আছে আবিরের জন্য কিন্তু আবিরের আজ দেখা নেই। কোথায় আবির??

এদিকে আবির ১২ টার দিকে তার গ্রামের বাড়িতে পৌছায়। আবির বাড়িতে ঢুকতে দেখে অনেক লোক। আবিরের বুকটা অজানা ভয়ে কেপে উঠে। আবির দৌড়ে তার মায়ের রুমে যায়। এরপর আবির যা দেখে তা হয়তো পৃথিবীর কোন সন্তানই স্বপ্নেও এ দেখতে চাবে না।

হ্যা আবিরের মা আর বেচে নেই। আপনারা ঠিকই ধরেছেন। সাদা কাপড়ে মোড়ানো আবিরের মা শুয়ে আছে। একেবারেই ঘুমিয়ে গেছে আবিরের মা। আর কোনদিন জাগবে না। উঠে বলবে না, বাবা আবির আয় তোকে ঘুম পরিয়ে দি আয় তোকে খাইয়ে দি।

আবিরের মাথায় শুধু গতরাতে মায়ের প্রতিটি কথা ঘুরছে। মা হয়তো বুঝে গিয়েছিলো সে আর বাচবেনা। তাই হয়তো ছেলেকে শেষবারের মতো একবার দেখতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে সময়টুকুও পেলো না আবিরের মা।

আবিরঃ মা ও মা। দেখো আমি এসেছি। তুমি বলেছিলে না আসতে। দেখো আমি এসেছি। উঠো না মা উঠো। একটু আদর করে দেও। তুমিও চলে গেলে আমি যে এতিম হয়ে যাবো মা। উঠো না। মা….

আবিরের মা আর উঠে না। সে যে আজ না ফেরার দেশে। খুব কষ্ট হচ্ছে আবিরের। বুকের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। আবির আর পারে না নিজেকে ধরে রাখতে এতোটা কান্নায় ভেঙে পরে যে উপস্থিত সবার হৃদয়ে সেই কান্না তীরের মতো গিয়ে লাগে। এক সদ্য এতিম ছেলের কান্না। সেখানে কারো আবিরকে শান্তনা দেওয়ার মতো সাহস কিংবা ভাষা নেই যা আবিরকে শান্ত করতে পারবে।

বাবা মা হারানো কতটা কষ্টের তা একমাত্র যারা হারিয়েছে তারাই বুঝতে পারবে। বাবা-মা হলো এমন এক সম্পদ যার কাছে আছে তার চেয়ে ধনী ব্যাক্তি এ দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কিন্তু সেই আমরাই জেনে কিংবা না জেনে প্রতিনিয়ত আমাদের বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি।

আবির তার মাকে কবর দিয়ে ২ দুদিন পর ঢাকায় চাচার কাছে ফিরে আসে। আবিরের চাচা আর মায়া আবিরকে দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাচে। খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিল তারা।

চাচাঃ কিরে আবির কি হয়েছে তোর??এ ২ দিন কোথায় ছিলি??ফোনও বন্ধ। আর তোর এ অবস্থা কেন বাবা??

আবির কাদতে কাদতে বলে,
আবিরঃ চাচা…মা…মা আর নেই।(অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙে পরে)

আবিরের চাচা আর মায়াও কান্নায় ভেঙে পরে।

আবিরের চাচা আবিরকে জরিয়ে ধরে।
চাচাঃ বাবা তোকে কি বলে শান্তনা দিবো আমার জানা নেই। তুই ভেঙে পরিস না। সবাইকেই একদিন এই দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে ওই উপরওয়ালার কাছে।আর কাদিস না বাবা আর কাদিস নাহ।

আবির অনেক ভেঙে পরেছে। ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছে। সারাদিন নিজেকে রুমে বন্দী করে রাখে। কারো সাথে কথা বলে না।কোথাও যায় না। শুধু মায়ের জন্য কাদে। মায়া মেয়েটা প্রতিদিন অনেক চেষ্টা করছে আবিরকে এই ডিপ্রেশন থেকে বের করতে কিন্তু পারছে না।

এদিকে আজ প্রায় ২৬ দিন হয়ে গেলো। আবিরের কোন খবর নেই। রিয়া পাগলের মতো আবিরকে খুজছে কিন্তু আবিরের কোন খবর নেই। ফোনও বন্ধ। আবির যে এভাবে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে সে কল্পনাও করেনি। রিয়া মুখের সেই উজ্জ্বলতা আর নেই। একদম মন মরা হয়ে থাকে। সেও এখন ভারসিটিতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।

আরো অনেকটা দিন কেটে যায়। আবির এখন কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মায়ের শেষ কথা গুলো তার জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু একরাতে আবির পানি খাওয়ার জন্য যখন খাবার টেবিলের কাছে আসে তখন চাচা চাচির রুম থেকে চাচির কিছু কথা শুনতে পায়। চাচা ঢাকাতে নেই। কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছে। তার মানে চাচি ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। আবির কান পেতে শুনার চেস্টা করে।

চাচিঃ আরে রানা(চাচির আপন ভাই) বলিস নাহ। মহিলাটা মরছে মরছে কিন্তু আপদটাকে আমার বাসায় রেখে গিয়েছে। সারাদিন বাসায় পরে থাকবো। কাম নাই কাজ নাই খালি খাইবো আর ঘুমাইবো। পড়া লেখাও এহন ছাইড়া দিছে। আমার কি ঠেকা পরছে নাকি ওরে এমনে পালমু। খালি তোর দরদী দুলাভাই আর ভাগ্নির লইগা ওরে ঘর থেকে বের করতে পারি না। একটা বোঝা বুঝলি।

আবির চাচির কথা শুনে ওর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি আদও যা শুনেছে ঠিক শুনেছে কিনা। আবির আবার ভেঙে পরে। ও ভাবে, চাচিতো সত্যিই বলেছে কেন সে আমার মতো বোঝাকে পালবে। যে শুধু তাদের কষ্টই দেয়। আবির বুঝতে পারছে জীবন কতটা নির্মম হতে পারে। আবির আর একমুহূর্ত এখানে থাকবে না। এখানে থাকার বিন্দু মাত্র অধিকার তার নেই।

আবির তার ব্যাগ আর মায়ের কিছু শেষ স্মৃতি নিয়ে দরজা দিয়ে বের হতে নিলে কেউ একজন তার হাতটা পিছন থেকে ধরে ফেলে। আবির পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে মায়া।

মায়াঃ কোথায় যাচ্ছো তুমি?? তাও আবার না বলে। আমাকে না বলে।

আবিরঃ মায়া আমি এ বাসা থেকে একেবারেই চলে যাচ্ছি। আর কোনদিন ফিরবো না।(মায়া কাদছে)মায়া আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। আমি তোমার ডাইরিটা সেদিন পড়েছিলাম।তুমি এখনো খুব ছোট। জীবনটা যে কতটা কঠিন তা তুমি এখন বুঝবে না।হয়তো কোন দিনও বুঝবে না। কারণ তোমার বাবা মা আছে। আমার নেই। তাই আমি বুঝতেছি। আমি এখন এতিম। আমি এখন নিস্ব। আমার এখন কিছুই নেই। নেই কোনো ভবিষ্যৎ। তাই অন্ধকার জীবনে তোমাকে সঙ্গী করা অসম্ভব। ভালো থেকো।

আবির চলে যেতে নিলেও মায়া আবিরের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে কাদো অবস্থায় মাথা নেরে শুধু না না করছে। আবির মায়ার কপালে শেষ চুমু দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পরে মায়ার ছোট ঘরের ভালোবাসা থেকে।

আবির অনেকটা পথ হেটে এসে কাদতে কাদতে রাস্তা আইল্যান্ডে বসে পরে। তার সব শেষ। এখন চারকূলে আর কেউ নেই আবিরের। সে এখন বড়ই একা। আবিরের জীবনটা এখানেই থেমে যায়।
[[[[সমাপ্ত]]]]

কোনো ভুল হলে মাফ করবেন।

কেমন লাগলো গল্পটি জানাবেন আপনার মন্তব্যটি।

আর আবিরের বাকি জীবনটা কিভাবে কেটেছে তা আপনারা যদি জানতে চান তাহলে এই ছোটঘরের ভালোবাসার সিজন ২ নিয়ে আসবো সাথে থাকুন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে