স্যার যখন স্বামী পার্ট_১৬

0
3769

স্যার যখন স্বামী
পার্ট_১৬
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস

“কতটা বছর অপেক্ষা করেছেন!মানে?”
“কিছু না,তুমি বুঝবে না।”
“(আজব না বুঝালে কি করে বুঝবো)”
“সময় আসলে বুঝবে,এখন না বুঝলেও চলবে।”

রাতে,
বাসায় এসে উনার কথাগুলো ভাবলাম।উনার কথাগুলো শুনে মনে হল উনিও আমাকে ভালবাসেন।কিন্তু কই কখনো তো এই কথাটা উনি নিজের মুখে বলেননি যে,উনিও আমাকে ভালবাসেন।যদি একটাবার আমার কাছে এসে এই কথাটা বলতেন তাহলে…. হয়ত উনাকেও আমি আমার মনের কথাটা বলতে পারতাম।

“এটা তোমার জন্য,”
“কি এটা”
“বক্স খুলে দেখ”
“মোবাইল!”
“হুম এখন থেকে কোন সমস্যা হলে আমাকে কল দিতে পারবে”
“থ্যাংকস আপনাকে”
.
.
ইশ এখনি কারেন্ট চলে গেল।খুব গরম লাগছে।
“মেঘ একটা কাজ করি চল আজকে ছাদে গিয়ে গল্প করি।তুমি দুইটা বালিশ,আর চাদর নিয়ে আসো।আজকে ছাদে গিয়ে আকাশের চাঁদ তারা দেখে দেখে গল্প করবো।”
“হুম ভালো আইডিয়া।”
তারপর ছাদে গিয়ে সেখানে বালিশ আর চাদর বিছিয়ে দুইজনে সেখানে শুয়ে গেলাম।বাহ কি সুন্দর বাতাস বইছে আর তার সাথেতো আছে আকাশের চাঁদ তারা।
“মেঘ আকাশের এই তারাগুলো দেখে তোমার কি মনে হয়?”
“কিছুই মনে হয় না।আপনার কি কিছু মনে হয়।”
“হুম অনেককিছু।খুব অল্পবয়সে যখন বাবা আর আমার ছোট বোনটাকে হারায় তখন আমার সমবয়সীরা,আমার মা প্রায় বলত ওরা নাকি আকাশের তারা হয়ে গেছে।এত তারাদের মধ্যে কোন তারাটা যে আমার বাবা আর বোন সেটা খুঁজে বেড়ায়।জানি এইসব কথা আমাকে তখন শুধু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলত।কিন্তু এখন কেন জানি মনে হয় আমার বাবা,বোন এত তারাদের ভীড়ে কোন এক তারা হয়ে আছেন।আর হয়ত আমাকে সেখান থেকে দেখছেন।মাঝে মাঝে খুব চেষ্টা করি তাদেরকে এই তারাদের ভিতর থেকে বের করতে।”
“আপনার বোনও ছিল!?”
“হ্যা,”
“আপনার বাবা আর বোনকে খুব ভালবাসতেন তাই না?”
.
.
“হুম খুব ভালবাসতাম।জানো আজকে তোমাকে কিছু গোপন কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

আমার মা বাবা একে অপরকে খুব ভালবাসতেন।আমার মা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ছিলো তাই মায়ের পরিবার আমার বাবা আর মায়ের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি।মায়ের পরিবার অন্য আরেক জায়গায় তার বিয়ে ঠিক করে।কিন্তু আমার মা বাবা একে অপরকে খুব ভালবাসতেন।এই বিয়ে মায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া যেমন সম্ভব ছিলো না ঠিক তেমনি আমার বাবারো।তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় ওরা পালিয়ে বিয়ে করবে।বিয়ের পর বাবা যখন মাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যায় বাবার পরিবারো এই বিয়েটা মেনে নেয়নি।বরং বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেয় কারণ তারা জানিয়ে দিয়েছিলো হয় এই মেয়েকে ছাড়তে হবে আর নাহয় তাকে ত্যাজ্যপুত্র করা হবে।বাবা এই অবস্থায় মাকে ছাড়তে পারেনি তাই মাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।

এরপর তারা তাদের স্বপ্নের সংসারটা চালাতে থাকে।এর ২বছর পর আমি হয়।আর বাবা আস্তে আস্তে এর কয়েকবছর পর নিজের কষ্টের অর্থ দিয়ে একটু একটু করে বাড়ি বানায়।ভালোই চলছিলো সব কিছু।এর কয়েকবছর পর আমার ছোট বোন আসে।ছোট্ট একটা পুতুল লাগতো ওকে।এই ছোট পুতুলকে নিয়ে খেলতাম সারাদিন।কিন্তু আমাদের কপালে এই সুখ বেশিদিন টিকলো না।কারণ কয়েকবছর পর আমার বাবা আর এর পরপরি আমার ছোট বোনটা আমাদের ফেলে চলে যায়। খুব ভালবাসতাম ওদের।এইভাবে আমার ভালবাসার আপন মানুষগুলো আমাকে ছেড়ে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি। বর্তমানে আমার আপনজন বলতে শুধু আমার মা আর তুমি।”
.
.
এরপর হঠাৎ করে উনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রাখলেন।
“মেঘ বিশ্বাস করো ওইদিন আমি তোমাকে ইচ্ছা করে থাপ্পড় মারতে চায় নি।আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতে আর তুমি ও হ্যা বলেছো।তাই ক্লাস শেষ করে সেখানে তোমার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টার পর অপেক্ষা করার পরও যখন তোমার আসার কোন হদিস পেলাম না খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।মনে হল এই বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।জানো কি পরিমাণ ভয়,দুশ্চিন্তা আর খারাপ ভাবনা আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল তা তোমাকে বলে বুঝাতে পারবোনা। তোমার কাছে যে মোবাইল নেই সেটা পরে মনে পড়ল। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তখন।আর তোমার বান্ধবী তাসপিয়ার নম্বরও আমার কাছে নেই।হঠাৎ মনে হল তুমি বাসায় যাও নিতো।তাই তড়িঘড়ি করে বাসায় এসে পৌঁছলাম।বাসায় এসে তোমাকে দেখে অনেক শান্তি পেলাম যে তোমাকে আমি হারায়নি।তোমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে গেলাম আর পরক্ষণেই তোমার ওই ভুল কাজের কথা মনে পড়ে আমার রাগ উঠে গেল।রাগ সামলাতে না পেরে সেদিন তোমাকে আমি থাপ্পড় দিয়ে দিলাম।তোমাকে থাপ্পড় মারাতে যতটা না তুমি ব্যথা আর আঘাত পেয়েছ তার থেকেও অনেক বেশি ব্যথা আমার বুকে এসে লেগেছে।ভিতরে ভিতরে কি পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছিলাম তা তোমাকে দেখাতে পারছিলাম না।”
.
.
বউ আমি জানি আমার রাগ যখন নিজের কন্ট্রোলে থাকে না তখন কি করে ফেলি আমি নিজেও জানি না।শুধু যাদেরকে আপন ভাবি তাদেরকে আঘাত করে ফেলি।মাঝেমাঝে আমার খুব ভয় হয় জানো?শুধু মনে হয় আমার এই রাগ আর কড়া কথা শুনে তুমি কোনদিন না আমাকে ভুল বুঝে আমাকে ছেড়ে চলে যাও।বউ আমি যেমনি হই না কেন প্লিজ আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যেও না।
.
.
বুঝতে পারছি কথাগুলো বলার সময় উনার গলা ধরে আসছিলো।কান্নাও করছেন সেটা বুঝতে পারছি কারণ উনার চোখের পানিতে আমার গলা ভিজে যাচ্ছে।
অনেক চাপাস্বভাবের মানুষ উনি এতদিন উনার সাথে থেকে তা বুঝে গেছি। “সরি” সামান্য একটা শব্দ বলতে যে মানুষটার ইগোতে অনেক লাগে আজ সেই মানুষটা নিজের গোপন কথাগুলো এইভাবে আমার সামনে প্রকাশ করবে,আর সেই ভুলের জন্য গোপনে কাঁদবে আমি তা ভাবতেই পারিনি।
.
.
মুখটা উপরে তুলে উনি বলতে শুরু করলেন বউ প্রমিস করো আমাকে না বলে আর কোথাও যাবে না।এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করবে না।কোথাও গেলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।

মাকে অনেক বলেছিলাম এখানে থাকতে কিন্তু উনি থাকেননি।বাবার বাড়িতে উনার প্রাণ পড়ে আছে তাই সেখানে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।এই বাসায় এখন আমার সাথে একমাত্র তুমি আছো। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে অনেক স্মরণীয়।বাসার বারান্দায় তোমার আর আমার আমাদের অনেক স্মৃতি জমে আছে।আচ্ছা তুমি চাইলে কি সে স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে পারবে?আমি কোনদিনও সে স্মৃতিগুলো ভুলতে পারবো না।ওইদিনগুলো যখনি মনে পড়ে নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়।মনে হয় আমার সবকিছুতে তুমি জুড়ে আছো।নিজেকে তখন আর একা লাগে না।
এরপর উনি আমার ডান গালের কাছে এসে সেখানে চুমো দিলেন।আমাকে ভুল বুঝে কখনো ছেড়ে চলে যেও না প্লিজ।তাহলে বড্ড একা হয়ে যাবো আমি।
.
.
“হ্যা আপনাকে ছেড়ে কখনো যাবো না।এবার ঘুমিয়ে যান।”আমার এই কথায় মনে হল যেন তিনি তার প্রাণ ফিরে পেয়েছেন।
“হুম,আমার লক্ষ্মী বউ “বলে আমার কপালে ভালাবাসার স্পর্শ দিলেন।
আজকে নিজের থেকেও অনেক হাল্কা লাগছে।দিন দিন উনাকে যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।এই লোকটার ভিতরের মনটা যে এত কোমল উনার সাথে না থাকলে না মিশলে বুঝতে পারতাম না।
.
.
সকালে,,
প্রতিদিনকার মতন আজকেও ভার্সিটি গেলাম।আজকে তেমন ক্লাস নেই।মাত্র ৩টা ক্লাস ছিলো।তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি আর তাসপিয়া গল্প করতে করতে গেইটের বাইরে চলে আসলাম।
“এই মেঘ কি খবর,”(সাব্বির)
“এইতো ভালো,”
“চলো না আজকে কোথাও থেকে ঘুরে আসি,তাসপিয়া তুমিও চলো। ২জনকে আজকে আমি খাওয়াবো,”(সাব্বির)
“না, না তা লাগবে না,আমি এখন বাসায় চলে যাব।”
“মেঘ তুই এমন করছিস কেন?চল না একটু ঘুরে আসি।দোস্ত আমার দিকটাও বুঝার চেষ্টা কর।”(তাসপিয়া)
আমি তাসপিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।বেচারি, সাব্বিরের সাথে থাকার জন্য এখন ও আমাকে টানছে।সাব্বিরের প্রেমে পুরা দিওয়ানা।
“আচ্ছা চল,”
“থ্যাংকস দোস্ত,,”(তাসপিয়া)
“তাহলে চলো,”(সাব্বির)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে