শেষ_পর্যন্ত পার্ট: ৯

0
1993

শেষ_পর্যন্ত

পার্ট: ৯

লেখিকা: সুলতানা তমা

আলিফা আমার কাধে মাথা রেখে বসে আছে আর আমি মনের আনন্দে ড্রাইভ করছি….

একটা রেস্টুরেন্ট এর সামনে এসে গাড়ি থামালাম।
–রিফাত এখানে গাড়ি থামিয়েছ কেন
–খিদে লেগেছে তাই
–বাসায় গিয়ে একেবারে খাবো প্লিজ
–ততোক্ষণে আমার পেটের পোকাগুলো সব মারা যাবে
–ঠিক আছে তুমি খেয়ে এসো আমি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছি
–তুমি তো কিছু খেয়ে আসোনি তুমিও চলো
–না
–যাবে না তো
–না
–ওকে (ওর ঠোঁটের কাছে আমার ঠোঁট নিতেই তাড়াতাড়ি সরে গেলো)
–রিফাত এসব কি হচ্ছে
–তুমি না গেলে আমি তোমার ঠোট….
–ছিঃ তুমি এতো খারাপ
–যা খুশি ভাবো আমার কিচ্ছু যায় আসেনা কারণ তুমি আমার বউ
–(রাগী চোখে তাকিয়ে আছে)
–তোমার এই রাগী চোখ দেখেই প্রথম দেখায় ভালোবেসেছি, এভাবে আর তাকিয়ো না রাগিণী প্লিজ পাগল হয়ে যাবো
–আবার রাগিণী ডাকছ
–সবসময় ডাকবো, এখন কি নামবে নাকি….
–প্লিজ রিফাত আমার ভালো লাগছে না আমি তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে চাই। (আমার খিদে লেগেছে শুনেও আগে বাসায় যেতে চায়, জানি তো রাতুলের সাথে কথা বলার জন্য এতো পাগল হইছে বলুক আর বাধা দিব না)

রাতুল নামটা শুনলেই রাগ হয়, রাগে খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছি।
–রিফাত আস্তে চালাও আমার ভয় করছে
–(নিশ্চুপ)
–রিফাত প্লিজ আস্তে চালাও আমার খুব ভয় করছে (ওর কোনো কথা না শুনে রাগে গাড়ি চালাচ্ছি)

বাসার সামনে এসে গাড়ি থামাতেই আলিফা নেমে এসে আমার কলার ধরে রাগে চেঁচামেচি করতে শুরু করলো।
আলিফা: এভাবে কেউ গাড়ি চালায় হ্যাঁ, কি হয়েছিল তোমার এতোবার বারণ করার পরও আমার কথা শুননি কেন
আমি: আলিফা আমার কলার ছাড়ো
আলিফা: কেন ছাড়বো আজ যদি কিছু একটা হয়ে যেতো তখন কি হতো (ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলাম)
আমি: কি হতো এক্সিডেন্ট…? তাহলে তো ভালই হতো মরে যেতাম তোমার মুখে অন্তত আর রাতুল নামটা শুনতে হতো না
আলিফা: তুমি আমার উপর রেগে এ….
কি হয়েছেরে আলিফা (হঠাৎ আলিফার আব্বুর কন্ঠ শুনে দুজন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালাম)
আলিফা: আব্বু যেন এসব কিছু জানতে না পারেন (আমার কাছে এসে আস্তে বললো, হুহ বাবার সামনে কি ভদ্র মেয়ে যতো যন্ত্রণা সব আমাকে দেয়)
আলিফা: কিছু হয়নি আব্বু ভিতরে চলো

ভিতরে এসে আমি শশুড় মশাইয়ের সাথে গল্প করছি আর আলিফা এক দৌড়ে ওর রুমে চলে গেলো। হয়তো রাতুলকে ফোন দিবে তাই। আমার ভাগ্য দেখলে আমার নিজেরই হাসি পায়।
আব্বু: রিফাত তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও বাবা পরে কথা হবে
আমি: ঠিক আছে

রুমে এসে দেখি আলিফা গোমরা মুখে বসে আছে রাতুল মনে হয় ফোন রিসিভ করেনি আহারে।
–কি হয়েছে রাগিণী মুখটা এমন প্যাঁচির মতো বানিয়ে রেখেছ কেন
–কি বললে আমি প্যাঁচি
–না তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে
–দেখনা এতো তাড়াতাড়ি আসলাম রাতুলের সাথে কথা বলবো বলে কিন্তু এসে দেখি ফোনে চার্জ নেই
–আমি খুশি হয়েছি (আস্তে বললাম)
–কি বললে
–ওয়াশরুমটা কোন দিকে (রাগে গজগজ করতে করতে দেখিয়ে দিলো)

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আলিফা রুমে নেই, ওর ফোনটা চার্জে দেওয়া দেখেই মাথায় দুষ্টুমি ঘুরতে শুরু করলো। ফোনটা চার্জ থেকে খুলে রেখে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু এমনটা করলাম না পরে আবার রাগিণী কান্না করবে। ওর কান্না দেখলে তো আমারই কষ্ট হয়।
আলিফা: এই তুমি আমার ফোনের কাছে কি করছ
আমি: তোমার ফোনের চেহারা দেখছিলাম
আলিফা: সবসময় এতো ঝগড়া করার ধান্দায় থাকো কেন
আমি: রাগিণীর সাথে ঝগড়া করতে আমার ভালো লাগে তাই
আলিফা: উফফফ যাও তো ড্রয়িংরুমে যাও আব্বু তোমার জন্য বসে আছেন
আমি: তোমাকে ছেড়ে আমি কোত্থাও যাবো না (ওকে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম)
আলিফা: আসার সময় তো খুব বলেছিলে পেটে খিদে লেগেছে না খেলে পেটের পোকাগুলো সব মারা যাবে তা এখন কি আর খেতে হবে না
আমি: খিদে তো তখনি মিটে গেছে রাতুলের কথা শুনে (আস্তে বললাম)
আলিফা: কিছু বললে
আমি: না তো
আলিফা: হুম যাও
আমি: ওকে

ড্রয়িংরুমে এসে দেখি শশুড় আব্বু বসে বই পড়ছেন, টেবিলে খাবার রাখা। আমাকে দেখেই বললেন,
আব্বু: খেয়ে নাও বাবা
আমি: আপনি খাবেন না
আব্বু: না এখন খাবো না একটু বাইরে যাবো এসে খাবো তুমি খাও আসছি
আমি: ঠিক আছে।

উনি চলে গেলেন একা একা নতুন জায়গায় খাওয়া যায় নাকি তাও খাবার নিয়ে বসলাম। হঠাৎ মনে পড়লো আলিফা তো সকাল থেকে কিছু খায়নি বিকেল হয়ে গেছে ওর তো খিদে লেগেছে, খাবার রেখে রুমে আসলাম। মহারাণী জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে
আমি: আলিফা খাবে চলো
আলিফা: আমার খিদে নেই
আমি: আমি জানি তোমার খিদে আছে কিন্তু রাতুলের সাথে কথা বলতে পারছ না বলে মন খারাপ
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: চলো
আলিফা: বললাম তো খাবো না
আমি: আমাকে জোর করতে বাধ্য করো না
আলিফা: কি করবে তুমি হ্যাঁ কি করবে
আমি: দেখতে চাও কি করবো দাঁড়াও দেখাচ্ছি (আস্তে আস্তে আলিফার কাছে গিয়ে আচমকা ওকে কোলে তুলে নিলাম)
আলিফা: রিফাত কি করছ ছাড়ো
আমি: সরি ছাড়া যাবে না
আলিফা: পরে যাবো তো
আমি: আমি কি এতোই খারাপ নাকি যে নিজের বউ কে ফেলে দিবো
আলিফা: প্লিজ ছাড়ো (ওর কোনো কথা না শুনে কোলে করে একেবারে ডাইনিং এর কাছে নিয়ে আসলাম তারপর ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম)
আলিফা: এসব পাগলামির মানে কি রিফাত
আমি: তার আগে বলো তো দিন কয়বার খাও এতো ওজন কেন তোমার।মুটকি কোথাকার
আলিফা: কি বললে আমি মুটকি
আমি: হ্যাঁ
আলিফা: মুটকি বলেছ এখন তো আমি খাবো না
আমি: আজব তো আমি মজা করে বলেছি আর তুমি… ওকে তোমাকে নিজে খেতে হবে না আমি খাইয়ে দিচ্ছি
আলিফা: না না আমি নিজেই খাবো
আমি: একদম চুপ।
আলিফাকে খাইয়ে দিচ্ছি কেন যেন ও আজ ঝগড়া করছে না চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। আলিফা কতোদিন আমার থাকবে জানিনা যতোদিন থাকে ততোদিন নাহয় এভাবেই ভালোবেসে যাবো।
আলিফা: রিফাত তুমি কাঁদছ কেন (আলিফার কথা শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম, এসব ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখে পানি চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। আলিফার দিকে তাকিয়ে দেখি ও কাঁদছে)
আমি: রাগিণী তুমি কাঁদছ কেন
আলিফা: আসলে আব্বু ছাড়া কেউ কখনো এতো যত্ন করে খাইয়ে দেয়নি তো তাই….
আমি: এখন তো আমি আছি সারাজীবন তোমাকে এভাবেই ভালবাসবো।
আলিফা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল তখনি ওর ফোন বেজে উঠলো আর ও এক দৌড়ে রুমে চলে গেলো। জানি রাতুল ফোন দিয়েছে আর খেতে ইচ্ছে হলো না, রুমে গিয়ে ওকে ডিস্টার্ব করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না তাই বাসার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমার ভাগ্য দেখলে নিজেই অবাক হয়ে যাই, যখন নিলাকে ভালোবাসতাম তখন নিলাও আমাকে ভালোবাসতো কিন্তু নিয়তি আমাদের এক হতে দিলো না, নিলা আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। আর এখন আলিফাকে যখন ভালোবাসি আমাদের বিয়েও হলো তখন আলিফা অন্য কাউকে ভালোবাসে হাহাহা কি ভাগ্য আমার।
আলিফা: এই পাগলের মতো হাসছ কেন
আমি: বাব্বাহ এতো তাড়াতাড়ি কথা শেষ
আলিফা: হ্যাঁ রাতুল বলেছে রাতে ফোন দিবে
আমি: এজন্যই তোমাকে এতো খুশি দেখাচ্ছে
আলিফা: হুম এখন চলো এতিমখানায় যাবো
আমি: সন্ধ্যা হয়ে আসছে তো এই সময়….
আলিফা: চলো তো।
আলিফা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছি। এই প্রথম আলিফা খুশি মনে আমার হাত ধরেছে ভাবতেই তো আমার ভালো লাগছে।

এতিমখানায় এসেই আমাকে একা ফেলে বাচ্চাদের সাথে চলে গেলো। আমি পিছন পিছন গেলাম ওরা মাঠে খেলা করছে, আলিফাকে একদম ছোট বাচ্চাদের মতো লাগছে। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে পিচ্ছি আলিফার লাফালাফি দেখছি। কিছুক্ষণ পর আলিফা আমার কাছে আসলো।
আলিফা: সরি তোমাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলাম আসলে….
আমি: তুমি জানো এতোক্ষণ তোমাকে ছোট বাচ্চাদের মতো লাগছিল
আলিফা: তাই বুঝি
আমি: হ্যাঁ, আচ্ছা তোমার সেই বিড়ালটি কোথায় যার জন্য আমি তোমাকে পেয়েছি
আলিফা: জানিনা আমি তো এখানে ছিলাম না
আমি: ওহ
আলিফা: অন্ধকার হয়ে আসছে চলুন বাসায় ফিরে যাই
আমি: ওকে।

বাসার দিকে হাটতে হাটতে আসছি আর আলিফা এক মনে কথা বলে যাচ্ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছি। আগে তো ভেবেছিলাম রাতুলের সাথে কথা বলাতে ওকে আর বাধা দিবো না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। তাই বাধা দিতেই হবে এতো সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
আলিফা: রিফাত তুমি রুমে যাও ভুয়া রান্না করছে আমি ভুয়ার সাথে দেখা করে আসছি
আমি: ওকে

রুমে এসে পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই দেখি অনেকগুলো মিসডকল তাও ছোটমার, তাড়াতাড়ি ফোন দিলাম।
ছোটমা: কিরে শশুড় বাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে গেছিস
আমি: না ছোটমা ফোন সাইলেন্ট করা ছিল আর যেখানেই যাই মা কে কিভাবে ভুলি বলতো
ছোটমা: পাগল ছেলে, বউমা কোথায়
আমি: রান্না ঘরে
ছোটমা: সত্যি করে একটা কথা বলতো
আমি: কি বলো
ছোটমা: বউমা ওখানে গিয়ে তোর সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি তো
আমি: না তবে রাতুলের কথা একটু বেশি ভাবে, তুমি ভেবো না এসব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে
ছোটমা: ভাবনা তো আপনা-আপনিই চলে আসে…
আমি: ছোটমা প্লিজ
ছোটমা: আচ্ছা রাখি এখন
আমি: ঠিক আছে।
ফোন রেখে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি আলিফা দাঁড়িয়ে আছে। ছোটমার সাথে রাতুলকে নিয়ে কথা বললাম আলিফা শুনে ফেলেছে নাকি তাহলে তো ও আমায় অবিশ্বাস করবে।
আলিফা: রিফাত চলো আব্বু ডাকছেন (যাক হেসে হেসে কথা বলছে তারমানে শুনেনি)
আলিফা: কি হল কি ভাবছ চলো (আরে আলিফা কোন ফাকে শাড়ি পাল্টে নিয়েছে আমি তো লক্ষই করিনি, হলুদ রঙের শাড়িতে আলিফাকে বেশ মানিয়েছে)
আলিফা: আবার কোথায় হারিয়ে গেলে চলো
আমি: আলিফা তোমাকে হলুদ শাড়িতে দারুণ লাগছে।
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো, আমিও পিছন পিছন ড্রয়িংরুমে আসলাম।

ড্রয়িংরুমে বসে আছি আলিফা তাড়াহুড়ো করে আমাদের চা দিয়ে রুমে চলে গেলো, এতো তাড়া কিসের ওর বুঝতে পারলাম না।
আব্বু: রিফাত আলিফাকে নিয়ে তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিল
আমি: বলুন কি কথা
আব্বু: এখন শরীরটা ভালো লাগছে না বুঝতেই পারছ বুড়ো মানুষ কখন কি হয়, তুমি এখন রুমে গিয়ে রেস্ট নাও সকালে কথা বলবো
আমি: ঠিক আছে।

তাড়াহুড়ো করে রুমে আসলাম, আলিফা এভাবে আসলো কেন বুঝতে পারছি না। রুমের চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখলাম আলিফা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। ওহ তারমানে এই ব্যাপার এজন্যই এতো তাড়াহুড়ো কিন্তু আমি তো এখন শান্তিতে কথা বলতে দিবো না। আস্তে আস্তে গিয়ে আলিফাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলাম তারপর ওর পেটে হাত রাখলাম
আলিফা: রিফাত কি করছ ছাড়ো (ফিসফিসিয়ে বললো নাহলে যে রাতুল ফোনে শুনে ফেলবে)
আমি: ফোন রাখো (আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম)
আলিফা: না প্লিজ
আমি: ওকে (দুহাত দিয়ে ওর পেটে চাপ দিলাম)
আলিফা: রাখছি রাখছি প্লিজ ছাড়ো
আমি: আগে রাখো।
আলিফা ফোন রেখে আমার হাতের উপর ওর হাত রাখলো আমার হাত সরানোর জন্য, আমি ওর পেটে আরো জোরে চাপ দিয়ে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম
“ভালোবাসি তোমায় রাগিণী অনেক বেশি”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে