শেষ_পর্যন্ত পার্ট: ১০

0
1862

শেষ_পর্যন্ত

পার্ট: ১০

লেখিকা: সুলতানা তমা

আলিফার পেটে দুহাত দিয়ে চাপ দিয়ে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম “ভালোবাসি তোমায় রাগিণী অনেক বেশি”

আলিফা: রিফাত কি হচ্ছে কি ছাড়ো বলছি (আমাকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে আমার গালে থাপ্পড় মারলো। আমি বোকার মতো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বউকে ভালোবাসার শাস্তি বুঝি এভাবেই পেতে হয়।)
আলিফা: অনেক বার বারণ করেছি শুননি উল্টো তুমি তোমার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ
আমি: (নিশ্চুপ)
আলিফা: শুনো তুমি যদি আবার এমন করো তাহলে কিন্তু….
ওর পুরো কথা না শুনে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলাম।

রাত দশটা বাজে এখনো বাসার বাইরে আছি, এখানের কিছুই ছিনি না তাই রাস্তার পাশে বসে আছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো অচেনা নাম্বার রিসিভ না করে রেখে দিলাম। কিন্তু ফোনটা বারবার বেজেই চলছে তাই বাধ্য হয়ে রিসিভ করলাম
–হ্যালো
–কোথায় তুমি এতো রাত হয়েছে বাসায় আসছ না কেন (ভাবতেই পারিনি আমার খুঁজে আলিফা ফোন করবে)
–রিফাত আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন
–এমনি
–আব্বু চিন্তা করছেন তাড়াতাড়ি বাসায় এসো
–আব্বু চিন্তা করছেন তুমি তো আর করছ না
–তুমি আসবে কিনা
–রাখো আসছি।

ফোন রেখে বাসায় চলে আসলাম, আলিফা ড্রয়িংরুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, দেখেই তো আমার অবাক লাগছে।
আলিফা: কোথায় গিয়েছিলে
আমি: (নিশ্চুপ)
আলিফা: রুমে চলে যাচ্ছ যে খাবে না।
ওর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। একটু পর আলিফা খাবার নিয়ে রুমে আসলো
আলিফা: রিফাত প্লিজ খেয়ে নাও
আমি: (নিশ্চুপ)
আলিফা: আমার সাথে কথা বলবে না
আমি: কি কথা বলবো
আলিফা: সরি আসলে আগে এভাবে…
আমি: হুম আর বলতে হবে না
আলিফা: এইযে কান ধরছি আর হবে না (ভাবছিলাম রাগ করে থাকবো কিন্তু ওর কান ধরা দেখে সব রাগ হাওয়া হয়ে গেলো। ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়)
আলিফা: রিফাত প্লিজ খেয়ে নাও
আমি: ওকে (আলিফার হাত থেকে খাবারের প্লেট আনতে গিয়ে সামনে নজর পড়লো, সারা রুমে চোখ বুলালাম। এই রুমে যে সোফা নেই এইটা তো আগে লক্ষ করিনি)
আলিফা: কি দেখছ এভাবে মনে হচ্ছে সারাদিন এই রুম দেখনি
আমি: দেখেছিলাম তবে আমার সতিন যে নেই এইটা লক্ষ করিনি
আলিফা: মানে
আমি: এই রুমে কিন্তু সোফা নেই আজ কোথায় ঘুমাবে
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: আজ তোমার জায়গা আমার বুকে বুঝেছ রাগিণী হাহাহা (আলিফা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো, তারপর চলে যেতে লাগলো)
আমি: আলিফা কোথায় যাচ্ছ
আলিফা: তুমি খাবারটা খেয়ে নাও এখনি আসছি।
যাহ চলে গেলো।

খাবার খেয়ে এসে শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছি হঠাৎ আলিফা এসে রুমে ঢুকলো হাতে বিছানা আর বালিশ।
আমি: এসব কি
আলিফা: আগে জিজ্ঞেস করছিলে না কোথায় ঘুমাবো
আমি: হ্যাঁ তো
আলিফা: ফ্লোরে ঘুমাবো
আমি: পাগল হয়েছ
আলিফা: এছাড়া তো উপায় নেই অন্য রুমে ঘুমালে আব্বু সন্দেহ করবে
আমি: আলিফা প্লিজ কেন এমন করছ, দেখো আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে আর আমি তোমাকে ভালোবাসি প্লিজ তুমি মেনে নাও।
কিছু না বলে মৃদু হেসে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। আমিও আর কিছু না বলে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আসছে না।

কিছুক্ষণ পর আলিফার দিকে তাকালাম, পাগলিটা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছি ডিম লাইটের আবছা আলোতে ওকে দেখতে খুব মিষ্টি লাগছে। হঠাৎ মনে হলো আলিফা নিচে শুয়েছে যে ওর তো ঠান্ডা লেগে যাবে যদি জ্বর হয় তখন কি হবে। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না, আমিই নাহয় ফ্লোরে ঘুমাবো।
নেমে গিয়ে আলিফাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুয়ে দিলাম, এই প্রথম ওকে এতো কাছ থেকে এভাবে দেখছি কেমন যেন এক অনুভূতি কাজ করছে। আলিফার চোখে কিছু চুল এলোমেলো হয়ে পরে আছে, হাত দিয়ে আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে দিলাম তারপর ঘুমন্ত রাগিণীর কপালে একটা চুমু দিয়ে ফ্লোরে এসে শুয়ে পড়লাম।

হঠাৎ কারো উষ্ণ ছুঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো, তাকিয়ে দেখি আলিফা আমার বুকের কাছে শুয়ে আছে। মাথা কেমন যেন ভারী লাগছে কপালে হাত দিয়ে দেখি জলপট্টি। আমিও খাটে শুয়ে আছি, আমি তাকিয়েছি দেখে আলিফা উঠে বসলো
আমি: আলিফা কি হয়েছে
আলিফা: কে বলেছিল আমার জন্য দরদ দেখাতে
আমি: মানে
আলিফা: রাতে আমাকে খাটে শুয়ে দিয়ে নিচে ঘুমিয়েছ কেন। এখন যে জ্বর এসেছে কে সেবা করবে আর আমি তোমার পরিবারের সবাইকে কি জবাব দিবো
আমি: ফ্লোরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই তো তাই, চিন্তা করো না কমে যাবে
আলিফা: সারা রাত ধরে তোমার জ্বর, কমার কোনো নামই নেই এখন ভোরবেলায় একটু কমলো। উফফফ আব্বু আমাকে যা বকা দিয়েছে
আমি: সরি আমার জন্য তোমার আব্বু সব জেনে গেছেন
আলিফা: হুম হয়েছে
আমি: রাগিণী আজ আমার এতো কাছে ছিলে যে ব্যাপার কি (দুষ্টুমি করে বললাম)
আলিফা: অসুস্থ হয়েও এসব বলা ছাড়োনি, তুমি জ্বরের ঘোরে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলে আমার তো কিছু করার ছিল না তাই আ….
আলিফা রিফাত কি উঠেছে (হঠাৎ আলিফার আব্বুর কন্ঠ শুনে আলিফা দূরে গিয়ে বসলো)
আলিফা: হ্যাঁ আব্বু, জ্বরটাও অনেক কমেছে (আব্বু এসে আমার পাশে বসলেন, আলিফা তো ভয়ে একদম চুপসে গেছে)
আব্বু: আলিফা যা তো ডক্টর কে ফোন করে আসতে বল আর কিছু খাবার নিয়ে আয়
আলিফা: হুম।
আলিফা চলে যেতেই উনি আমার একটা হাত মুঠো করে ধরে কেঁদে দিলেন।
আমি: আব্বু কি হয়েছে
আব্বু: আমাকে ক্ষমা করে দিও আমি না জেনে তোমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম
আমি: মানে
আব্বু: রাতে যখন তুমি জ্বরে গোঙাচ্ছিলে তখন আলিফা ভয় পেয়ে আমাকে ডেকে আনে, আমি এসে তোমাকে ফ্লোরে দেখে ওকে অনেক প্রশ্ন করি। তারপর আলিফা আমাকে সব বলেছে। আমি আগে রাতুলের কথা জানতাম না বাবা জানলে এমন হতো না
আমি: আব্বু আমার ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে এতে কারো দোষ নেই
আব্বু: তবে একটা কথা বলি বাবা বিয়েটা যখন হয়েই গেছে আমি চাই আলিফা তোমারই থাক। আমার বিশ্বাস আলিফা একদিন তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারবে
আমি: গতকাল আপনি কি যেন বলতে চেয়েছিলেন
আব্বু: আমার অবস্থা বেশি ভালো না তাই বলতে চেয়েছিলাম আমার কিছু হয়ে গেলে আলিফাকে তুমি আগলে রেখো কিন্তু এখন তো সব উলটপালট হয়ে গেলো
আমি: কিচ্ছু হয়নি আব্বু সব ঠিক হয়ে যাবে
আব্বু: এতো কষ্ট লুকিয়ে কি করে পারছ এই কথা বলতে
আমি: (নিশ্চুপ)
আব্বু: আলিফা আমার নিজের মেয়ে না কিন্তু আমি ওকে নিজের সন্তানের চেয়ে বেশি ভালোবাসি, আমি যখন থাকবো না আমার মেয়েটা কে আগলে রেখো তুমি। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।
উনি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। সত্যিই কি কখনো সব ঠিক হয়ে যাবে…?
আলিফা: রিফাত ডক্টর আসছেন, তুমি কিছু খেয়ে নাও (আলিফা এসেছে খাবার নিয়ে, ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি আদৌ কি আলিফা আমার হবে)
আলিফা: এইযে কোথায় হারিয়ে গেলে খেয়ে নাও
আমি: ইচ্ছে করছে না
আলিফা: আমি খাইয়ে দিচ্ছি হা করো (আর কিছু বলতে পারলাম না চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছি)
আলিফা: চিন্তা করো না তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে
আমি: একটা কথা বলবো
আলিফা: বলো
আমি: এইযে আমার সেবা করছ ভালোবেসে করছ নাকি আমি অসুস্থ বলে সহানুভূতি….
আলিফা: কাঁদছ কেন
আমি: জানিনা।
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খাইয়ে দিচ্ছে আর আমি নিরবে কেঁদে যাচ্ছি। যখন ও থাকবে না তখন তো এসব স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়াবে যেমন করে নিলার স্মৃতি আজো আমায় তাড়া করে। হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো, আলিফা ফোন এনে নিজেই রিসিভ করলো।
আলিফা: হ্যালো আব্বু (এইরে আব্বু ফোন দিয়েছেন ও যদি বলে দেয় আমি অসুস্থ তাহলে তো বাসায় সবাই চিন্তা করবে)
আলিফা: না আব্বু রিফাত একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমরা দুদিন পর আসবো।
আমি: এই ফোন দাও তো (ওর থেকে ফোন কেড়ে আনলাম)
আমি: হ্যাঁ আব্বু
আব্বু: তুই নাকি অসুস্থ
আমি: তেমন কিছু না সামান্য জ্বর এসেছে
আব্বু: রিয়ানকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আলিফাকে নিয়ে বাসায় চলে আয়
আমি: আব্বু আমার কথা শুনো
আব্বু: কিচ্ছু শুনতে চাই না রেডি হয়ে থেকো রিয়ান যাচ্ছে।

আব্বু ফোন রেখে দিলেন। আলিফার দিকে রাগি চোখে তাকালাম।
আলিফা: কি হলো
আমি: যাও রেডি হয়ে নাও রিয়ান আসছে আমাদের নিতে
আলিফা: মানে কি আজই চলে যাবো
আমি: আমি যে অসুস্থ আব্বুকে বলতে গেলে কেন
আলিফা: এখন কি হবে
আমি: ডক্টরকে ফোন করে বলে দাও আসতে হবে না আর তুমি রেডি হয়ে নাও
আলিফা: সত্যি চলে যেতে হবে
আমি: আব্বু বলেছেন যেহেতু যেতেই হবে।
আলিফা মন খারাপ করে চলে গেলো।

বিছানায় শুয়ে আছি হঠাৎ আলিফা আর রিয়ান রুমে এসে ঢুকলো। আলিফার মুখটা গোমড়া হয়ে আছে হয়তো যেতে চায় না।
রিয়ান: ভাইয়া কি হইছে তোমার
আমি: এতো অস্থির হচ্ছিস কেন সামান্য জ্বর
রিয়ান: কিন্তু এসেই জ্বর বাধালে কিভাবে (আলিফার দিকে তাকালাম ভয়ে চুপসে গেছে যদি বলে দেই ফ্লোরে ঘুমিয়েছিলাম এই ভয়ে হয়তো)
আমি: গতকাল সন্ধ্যার পর একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম তাই একটু ঠান্ডা লেগে গেছে। তুই চিন্তা করিস না কমে যাবে
রিয়ান: ঠিক আছে এখন চলো ডক্টর দেখিয়ে একেবারে বাসায় যাবো
আমি: হুম
রিয়ান: ভাবি তুমি রেডি তো
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: ও মনে হয় যেতে চাচ্ছে না
রিয়ান: না গেলে হবে না আব্বু বলে দিয়ছেন যেহেতু যেতেই হবে। কি ভাবি যাবে না
আলিফা: হুম যাবো

আলিফার আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। রিয়ান ড্রাইভ করছে আলিফা আর আমি পিছনে বসেছি। আলিফা মুখ গোমড়া করে বাইরে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মাথা ঘুরতে শুরু করলো, ঠান্ডাটা ভালই লেগেছে। আমার অসস্থি দেখে আলিফা ঘাবড়ে গিয়ে আমার পাশে এসে বসলো।
আলিফা: রিফাত কি হয়েছে
আমি: একটু অসস্থি লাগছে
রিয়ান: ভাইয়া গাড়ি থামাবো
আমি: না তাড়াতাড়ি বাসায় চল এখন ডক্টর এর কাছে যাবো না
রিয়ান: ঠিক আছে।
কেমন যেন এক অসস্থি হচ্ছে নিশ্চুপ হয়ে বসতে পারছি না। আমার এই অবস্থা দেখে আলিফা আমাকে ইশারা দিয়ে বললো ওর কোলে মাথা রেখে শুতে। আমি তো অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আলিফা নিজেই আমাকে ওর কোলে শুয়ে দিলো তারপর আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলিফার হাতটা আমার দুহাতের মুঠোয় এনে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আলিফা: কি
আমি: চলেই যখন যাবে এতো মায়া বাড়াচ্ছ কেন
আলিফা: অসুস্থ হয়েও এতো কথা কিভাবে বলো
আমি: কথা ঘুরিয়ে নিচ্ছ কেন, বলো এতো মায়া বাড়াচ্ছ কেন
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: যখন চলে যাবে তখন তো এসব স্মৃতি হয়ে যাবে আর এই স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াবে। তখন আমি কিভাবে বাঁচবো, এই স্মৃতির তাড়া যে আমি বড্ড ভয় পাই।
আলিফা কিছু না বলে আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো….

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে